পটভূমি
নোবেল পুরষ্কার লাভ করার মাত্র পাঁচ মাসের মধ্যেই রাজনৈতিক দল গঠন করার কার্যক্রম শুরু করে সবাইকে অবাক করে দিয়েছিলেন অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস। ২০০৭ সালের ১১ই জানুয়ারি সেনাবাহিনীর সমর্থনে ফখরুদ্দিন আহমদের নেতৃত্বে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠিত হয়। এর কিছুদিন পর থেকেই অধ্যাপক ইউনূসের রাজনৈতিক দল গঠনের গুঞ্জন শুরু হয়। যদিও ফখরুদ্দিন আহমদকে তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রধান করার আগে সেনাবাহিনীর তরফ থেকে অধ্যাপক ইউনূসকে প্রস্তাব দেয়া হয়েছিল।
১/১১ এর তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রধান হবার প্রস্তাব কেন ফিরিয়ে দিয়েছিলেন ড ইউনূস ?
- ২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারি ফখরুদ্দিন আহমদকে তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রধান করার আগে নোবেল জয়ী অধ্যাপক ইউনূসকে প্রস্তাব দিয়েছিলেন সেনাপ্রধান মঈন ইউ আহমেদ। কিন্তু সেই প্রস্তাব এর শর্ত মনপুত না হওয়ায় তা ফিরিয়ে দিয়েছিলেন ড. ইউনূস।
- স্বল্প মেয়াদী সরকার হওয়ায় কেয়ারটেকার প্রধান হওয়ার প্রস্তাবে রাজি হননি ড. ইউনূস। তার স্বপ্ন ছিল দীর্ঘ সময় ক্ষমতায় থাকা। আর এ জন্য ‘নাগরিক শক্তি’ নামে নতুন দল গঠনও করেছিলেন তিনি। তবে তীব্র সমালোচনার মুখে বাধ্য হয়েই রাজনীতি থেকে সরে এসেছিলন ইউনূস।
নিজস্ব রাজনৈতিক দলগঠনের ইচ্ছা
- ২০০৭ সালের জানুয়ারি মাসের শেষের দিকে অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস ভারত সফরে যান। সে সফরে তিনি রাজনীতিতে যোগ দেবার জোরালো সম্ভাবনার কথা তুলে ধরেন। ৩১শে জানুয়ারি দিল্লীতে এক সংবাদ সম্মেলনে অধ্যাপক ইউনূস বলেন, দেশের পরিস্থিতি বাধ্য করলে তিনি রাজনীতিতে যোগ দেবেন।
- অধ্যাপক ইউনূসকে উদ্ধৃত করে দৈনিক আমার দেশ লিখেছিল, রাজনীতিতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করার মতো ব্যক্তি আমি নই। কিন্তু পরিস্থিতি যদি বাধ্য করে তাহলে রাজনীতিতে যোগ দিতে আমি দ্বিধা করবো না।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে সমর্থন এবং রাজনীতিবিদদের তীব্র সমালোচনা
- জরুরী অবস্থা জারির পর থেকে অধ্যাপক ইউনূস বিভিন্ন সময় দেশের প্রচলিত রাজনীতি এবং রাজনীতিবিদদের কড়া সমালোচনা করেন এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে সমর্থন দেন।
- দিল্লিতে সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, রাজনীতিবিদরা দেশকে এলডিসির (অনুন্নত দেশসমূহ) পর্যায় থেকে আরো উন্নত পর্যায়ে আনতে চান না। কারণ এতেই তারা নিজেদের লাভ দেখতে পান।
- ভারত সফর শেষে অধ্যাপক ইউনূস বাহরাইন সফরে যান। সেখান থেকে ফিরে তিনি ঢাকা বিমানবন্দরে সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের জবাব দেন। সেখানে তিনি ‘দুর্নীতি-বিরোধী অভিযানের নামে দেশের রাজনীতিবিদদের গ্রেফতারকে’ সমর্থন করেন।
ইউনূসের খোলা চিঠি
- ২০০৭ সালের ১১ই ফেব্রুয়ারি অধ্যাপক ইউনূস দেশের মানুষের উদ্দেশ্যে খোলা চিঠি দেন। সে চিঠিতে অধ্যাপক ইউনূস বলেন, নতুন রাজনীতি সৃষ্টির জন্য প্রচণ্ড উদ্যোগ নিতে হবে। এটি করতে না পারলে পুরনো রাজনীতি থেকে পরিষ্কারভাবে বেরিয়ে আসা সম্ভব হবে না।
- খোলা চিঠিতে তিনি আরো উল্লেখ করেন , ‘আমি জানি, রাজনীতিতে জড়িত হওয়া মানে বিতর্কিত হওয়া। আপনার যদি মনে করেন, আমার রাজনীতিতে আসাটা দেশে নতুন রাজনৈতিক পরিমণ্ডল রচনায় সহায়ক হবে তবে আমি তার জন্য এ ঝুঁকি নিতে প্রস্তুত আছি’।
- একটি নতুন রাজনৈতিক দল কীভাবে গঠন করা যায়, কিভাবে সৎ ও যোগ্য প্রার্থীদের নির্বাচনে মনোনীত করা যায়, কিভাবে তৃণমূল থেকে সরাসরি মতামত পাওয়া যায় – এসব বিষয় নিয়ে তিনি মানুষের মতামত এবং পরামর্শ জানতে চান।
প্রয়োজনে গ্রামীণ ব্যাংক ছেড়ে দেবেন
· যেই গ্রামীণ ব্যাংকের এমডি’র পদ আকড়ে থাকার জন্য আন্তর্জাতিক বন্ধুদের সাথে নিয়ে বাংলাদেশ সরকারের সাথে তীব্র লড়াই করলেন, আমেরিকান এম্বেসি, ইউএসএইড প্রধানের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রীর ছেলেকে হুমকি ধামকি দিলেন, সেই গ্রামীণব্যাংকও ছেড়ে দিতে চেয়েছিলেন ডঃ ইউনুস শুধুমাত্র ক্ষমতার শীর্ষে উঠার জন্য।
· কলকাতায় গিয়ে তিনি রাজনৈতিক দল গঠনের বিষয়টি নিয়ে সেখানকার সাংবাদিকদের নানা প্রশ্নের জবাব দেন। ঢাকায় ফিরে তিনি বিমানবন্দরে সাংবাদিকদের সাথে তিনি বলেন, রাজনৈতিক দল গঠনের জন্য তিনি প্রয়োজনে গ্রামীণ ব্যাংক ছেড়ে দেবেন।
দলের নাম ‘নাগরিক শক্তি’
- ২০০৭ সালের ১৮ই ফেব্রুয়ারি অধ্যাপক ইউনূস চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় ফিরে বিমানবন্দরে সাংবাদিকদের বলেন, তার দলের সম্ভাব্য নাম ‘নাগরিক শক্তি’।
- এসময় তিনি বলেন, রাজনৈতিক দল গঠনের প্রক্রিয়া থেকে তার সরে আসার সুযোগ নেই। ‘এখন এগিয়ে যেতে হবে, গ্রামে গ্রামে গঠিত হবে ড. ইউনূস সমর্থক গোষ্ঠী। এখনকার অবস্থায় রাজনীতি না করার আর কোন অবকাশ নেই।‘
- দৈনিক প্রথম আলো পত্রিকার খবরে বলা হয়, ২২শে ফেব্রুয়ারি দুবাই যাবার আগে বিমানবন্দরে তিনি রাজনৈতিক দল গঠনের আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেন। এসময় তিনি একটি লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন এবং সাংবাদিকদের নানা প্রশ্নের জবাব দেন।
- বিভিন্ন গ্রামে, মহল্লায় এবং ওয়ার্ডে ২০ সদস্যের প্রাথমিক প্রস্তুতি টিম গঠনের আহবান জানান তিনি। এ সময় অধ্যাপক ইউনূস তার রাজনৈতিক দলের নীতি ও আদর্শ ঘোষণা করেন।
ডঃ ইউনুসের রাজনৈতিক লিপ্সার সমালোচনা
- ইতোমধ্যে চারিদকে প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে যে জরুরী অবস্থা চলাকালীন সেনা-সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সহায়তায় অধ্যাপক ইউনূস রাজনৈতিক দল গঠনের সুযোগ নিচ্ছেন।
- ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তনে অধ্যাপক ইউনূসকে আমন্ত্রণ জানানো হলে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি সমর্থিত শিক্ষকদের একটি অংশ তার প্রতিবাদ জানাতে শুরু করে। অধ্যাপক ইউনূস সমাবর্তনে যোগ দিলে শিক্ষকদের একটি অংশ সেটি বর্জনের হুমকিও দেয়।
- তিনি জরুরী অবস্থায় দল গঠনের সুযোগ নিচ্ছেন কি না? সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাবে অধ্যাপক ইউনূস বলেন, ” আমি তো দল করতেই চাইনি। বলেছিলাম, নির্বাচনটা হয়ে যাক। কিন্তু এখন নতুন পরিস্থিতিতে মনে করছি দল গঠন করা উচিত।”
আওয়ামী লীগ ও বিএনপির প্রতিক্রিয়া
- অধ্যাপক ইউনূস যখন রাজনীতিতে আসার প্রক্রিয়া শুরু করেন তখন সেটির কড়া সমালোচনা করেছিলেন আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা। শেখ হাসিনাকে উদ্ধৃত করে বার্তা সংস্থা রয়টার্স লিখেছিল, “যারা রাজনীতিতে নতুন আসে তারা ভয়ঙ্কর হয়। তাদের তৎপরতা সন্দেহ করার মতো। তারা জাতির ভালো করার পরিবর্তে আরো বেশি খারাপ করে।‘
- যদিও বিএনপির তরফ থেকে ডঃ ইউনুসের রাজনৈতিক দল গঠনের ইচ্ছাকে স্বাগত জানানো হয়েছিল। বিএনপির নেতাদের কথায় সে সময় ডঃ ইউনুসের দলের প্রতি খুব আগ্রহ দেখা যেতো। এছাড়া বিএনপি-পন্থী পত্রিকা দৈনিক আমার দেশ তাদের এক সম্পাদকীয়তে লিখেছিল – এবারের সিদ্ধান্তই সঠিক।
দল গঠনে ব্যর্থতার কারণ ও সরে আসা
- ২০০৭ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে এপ্রিল মাসের মাঝামাঝি পর্যন্ত দুই নেত্রীকে রাজনীতি থেকে বাইরে রাখা কিংবা বিদেশে পাঠিয়ে দেবার নানা চেষ্টা অব্যাহত রেখেছিল সেনা-সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার। অধ্যাপক ইউনূস সে পরিস্থিতির সুযোগ নিতে চেয়েছিলেন বলে অনেকে মনে করেন।
- কিন্তু এপ্রিল মাসের মাঝামাঝি সময়ে এসে মোটামুটি পরিষ্কার হয়ে যায় যে শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়াকে রাজনীতি থেকে দূরে রাখা সম্ভব হবে না। কিংবা তাদের বিদেশেও পাঠানো যাবে না। এ কারণেই ডঃ ইউনুস নিজস্ব রাজনৈতিক দল গঠনের বিষয়ে একটু দ্বিধায় পরে যান।
- এছাড়াও ডঃ ইউনুস বিভিন্ন দলের রাজনৈতিক নেতাদের সাথে নিজের দলে যোগদানের বিষয়ে আলাপ আলোচনা শুরু করেন। এর মধ্যে হেভিওয়েট নেতা থেকে শুরু করে মধ্যম সারির নেতাও ছিলেন। ধারণা করা হয়, এইসকল আলোচনা খুব একটা ফলপ্রসু হয়নি, বা লেনদেনের হিসাব মেলেনি , তাই বাকি আগ্রহটুকুও হারিয়ে ফেলতে থাকেন ডঃ ইউনুস।
- ২০০৭ সালের ৩রা মে অধ্যাপক ইউনূস রাজনৈতিক দল গঠনের প্রক্রিয়া থেকে সরে আসার ঘোষণা দেন। রাজনীতিতে আসার জন্য তিনি জনগণের উদ্দেশ্যে যে খোলা চিঠি দিয়েছিলেন তার তিনমাসের মধ্যেই সে প্রক্রিয়া থেকে সরে আসেন অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস।
- এজন্য তিনি জাতির উদ্দেশ্যে একটি চিঠি প্রকাশ করেন। সে চিঠিতে তিনি উল্লেখ করেন, “যাদেরকে সঙ্গে পেলে দল গঠন করে জনগণের সামনে সবল ও উজ্জ্বল বিকল্প রাখা সম্ভব হতো তাদের আমি পাচ্ছি না। আর যারা রাজনৈতিক দলে আছেন তারা দল ছেড়ে আসবেন না। বাস্তবতাকে মেনে নিয়ে এ পথে অগ্রসর না হওয়াই সঠিক হবে মনে করে এ প্রচেষ্টা থেকে সরে আসার সিদ্ধান্ত নিয়েছি,”