আন্দোলনের বিভিন্ন পর্যায়ে বিএনপি কখনো ১০ দফা, কখনো ২৭ দফা, কখনো ৩১ দফা এবং সর্বশেষে মার্কিন আন্ডারসেক্রেটারি আজরা জেয়ার সফরকালে এক দফা ঘোষণা করেছে। বিএনপি ও তার মিত্রদের এক দফা হলো নির্দলীয়, নিরপেক্ষ, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া তারা কোনো নির্বাচনে যাবে না, এটাই তাদের এক দফা। বিএনপি ও তার মিত্রদের সব কৌশল ও এক দফা বোধ করি বিফল হতে চলেছে। লবিং ও ভাড়াটিয়া বাহিনীর পেছনে ব্যয়কৃত এত বিশাল অর্থ কি তবে জলে গেল? কারণ অবাধ, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন বিষয়ে বিদেশিরা সরকারকে বারবার তাগিদ দিলেও নির্বাচনকালীন সরকার বিষয়ে তারা নীরব। কূটনীতিকরা নির্বাচনকালীন সরকার প্রশ্নে কোনো পক্ষ না নিয়ে নিজেদের সম্পূর্ণ দূরত্বে রাখছেন। কূটনীতিকদের অনেকেই বলেছেন, ‘নির্বাচনকালীন সরকার এ দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক বিষয়, যা রাজনীতিকদেরই সমাধান করতে হবে।’
কয়েক সপ্তাহ আগে নির্বাচনকালীন সরকার প্রসঙ্গে ঢাকার পূর্ব ও পশ্চিমা দেশগুলোর একাধিক রাষ্ট্রদূতের কাছে তাঁদের দেশের অবস্থান জানতে চেয়েছিল বেশ কয়েকটি জাতীয় দৈনিক। ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) অবস্থান জানতে চাইলে ঢাকার ইইউ ডেলিগেশনপ্রধান চার্লস হোয়াইটলি বলেন, ‘নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে আমাদের কোনো অবস্থান নেই।’ কয়েকজন কূটনীতিক বলেছেন, সরকার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য হবে, সে বিষয়ে আস্থা রয়েছে; তবে নির্বাচনের দিকে তীক্ষ দৃষ্টি রাখা হবে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন কূটনীতিক বলেছেন, ‘বাংলাদেশে সংবিধানে যেভাবে বলা রয়েছে, সে অনুযায়ী নির্বাচন চাওয়ার বাইরে কূটনীতিকদের অন্য কোনো উপায় নেই।’ মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের কাউন্সিলর ডেরেক এইচ শোলের কাছে বাংলাদেশে দলীয় সরকারের অধীনে প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচনের বিষয়ে উল্লেখ করে নির্বাচনকালীন নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিয়ে মূল্যায়ন জানতে চাওয়া হয়েছিল। এর উত্তরে সাংবাদিকদের তিনি বলেছিলেন, ‘নির্বাচনকালীন সরকার বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়। যে নির্বাচন হয়নি, সেটি নিয়ে অনুমান করা সম্ভব নয়।’ সরকারের প্রতিশ্রুতি নিয়ে ডেরেক শোলে বলেছিলেন, ‘সরকার বলেছে, তারা অবাধ ও স্বচ্ছ নির্বাচন করতে চায়। আমি আশ্বস্ত, সরকার অবাধ ও স্বচ্ছ নির্বাচন করতে চায়।’
১ মে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের উপপ্রধান মুখপাত্র বেদান্ত প্যাটেল বলেছেন, ‘বাংলাদেশের নির্বাচন কিভাবে হবে তা নির্ধারণ করবে জনগণ।’ মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়াবিষয়ক ব্যুরোর ডেপুটি অ্যাসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি আফরিন আক্তারের ঢাকা সফরকালে নির্বাচনে বিএনপি বা কোনো বিশেষ দলের অংশ নেওয়া-না নেওয়ার বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের উদ্বেগ আছে কি না এমন প্রশ্নের জবাবে বলেছেন, ‘নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবে কী করবে না, সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত মূলত দলের।’ অতি সম্প্রতি বাংলাদেশ সফর করে গেলেন মার্কিন আন্ডারসেক্রেটারি আজরা জেয়ার নেতৃত্বে উচ্চ পর্যায়ের প্রতিনিধিদল। বাংলাদেশ সফরকালে ইউএনবিকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে আজরা জেয়ার কাছে সম্ভাব্য তত্ত্বাবধায়ক সরকার বা নির্বাচন বর্জনের বিষয়ে জানতে চাওয়া হয়েছিল। তিনি স্পষ্ট করে বলেন, ‘এটা বাংলাদেশের জনগণের অভ্যন্তরীণ বিষয়। এ বিষয়ে আমরা যুক্তরাষ্ট্রের কোনো ভূমিকা দেখছি না। আমি শুধু বলতে চাই যে আমরা কোনো রাজনৈতিক দলের পক্ষ নিই না।’ উপরন্তু আজরা জেয়া বলেছেন, ‘প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, আইনমন্ত্রী আনিসুল হক, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান এবং পররাষ্ট্রসচিবের সঙ্গে যে আলোচনা হয়েছে, তাতে আমি সন্তুষ্ট।’ নির্বাচন সুষ্ঠু না হলে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র আরো কঠোর ব্যবস্থা নেবে—এমন আলোচনার বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশের সঙ্গে অংশীদারির স্বীকৃতি দিতে আমি এখানে এসেছি। যুক্তরাষ্ট্র এই সম্পর্ককে আরো নিবিড় করতে চায়। অবাধ ও মুক্ত ভারত ও প্রশান্ত মহাসাগর প্রতিষ্ঠার প্রত্যয়ে আমাদের মধ্যে ফলপ্রসূ আলোচনা হয়েছে।’
গত ১৫ জুলাই জাতীয় পার্টির সঙ্গে ইইউ প্রতিনিধিদলের বৈঠক হয়। আলোচনা শেষে সাংবাদিকদের ব্রিফিংকালে এক প্রশ্নের জবাবে জাতীয় পার্টির মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু বলেন, ‘নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে কথা বলতে ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের (ইইউ) প্রতিনিধিদল আগ্রহী নয়।’ সাংবাদিকরা জানতে চান নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে কোনো আলোচনা হয়েছে কি না? জবাবে তিনি বলেন, ‘নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে কোনো আলোচনা হয়নি, এ নিয়ে তাদের কোনো আগ্রহ নেই।’ জাতীয় পার্টির মহাসচিবের বক্তব্য থেকে স্পষ্টতই প্রতীয়মান হয় যে ইইউ প্রতিনিধিদলের সঙ্গে আলোচনায় নির্বাচনকালীন সরকার প্রসঙ্গ এসেছিল, কিন্তু ইইউ প্রতিনিধিদল তাতে আগ্রহ দেখায়নি। ইইউর সাবেক কমিশনার ও ধর্মবিষয়ক বিশেষ দূত বর্তমানে ইউরোপিয়ান ইনস্টিটিউট অব ইনোভেশন অ্যান্ড টেকনোলজির (ইআইটি) সদস্য ইয়ান ফিজেল ‘দি ইইউ মাস্ট নট সাপোর্ট আ কেয়ারটেকার গভর্নমেন্ট ইন বাংলাদেশ’ শীর্ষক এক নিবন্ধে বলেছেন, ইউরোপীয় ইউনিয়নের উচিত হবে না বাংলাদেশে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ব্যাপারে কোনোভাবেই সমর্থন দেওয়া। তাঁর মতে, অনির্বাচিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কাছে ক্ষমতা দেওয়া হলে তা আবারও সামরিক বাহিনীর হাতে চলে যেতে পারে। যেমনটা ঘটেছিল এখন থেকে ১৭ বছর আগে। এ বিষয়ে ফিজেল দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দুটি দেশ থাইল্যান্ড ও মিয়ানমারের দৃষ্টান্ত দিয়েছেন। তিনি বলেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকার এমন একটি ব্যবস্থা, যা বিশ্বের আর কোথাও নেই। ইয়ান ফিজেল নিবন্ধে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন, আগামী জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে বিরোধীদের নির্বাচন বয়কটের আশঙ্কা রয়েছে। সে ক্ষেত্রে এই অঞ্চলে আরেকটি সামরিক হস্তক্ষেপের মঞ্চও প্রস্তুত হচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে যদি সামরিক বাহিনীকে থামাতে হয়, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে সামরিক নেতাদের এটা অবশ্যই স্পষ্ট করে দিতে হবে যে এর পরিণতি হবে দ্রুত, অত্যন্ত কঠোর এবং ব্যক্তিগত।
দেশের সার্বভৌমত্ব বিকিয়ে বিদেশিদের অনুগ্রহে শেখ হাসিনাকে অপসারণে বিএনপির স্বপ্ন কিছুটা ফিকে হয়ে আসছে বলে মনে হয়, বিশেষ করে আজরা জেয়ার সফরের পর বিএনপি ও তার মিত্ররা বেশ খানিকটা হতাশ বলেই মনে হচ্ছে। সকালে আজরা জেয়া ঢাকা ত্যাগ করার পর বিকেলে এক সমাবেশে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল বলেন, ‘দরকার নেই আমাদের বিদেশিদের।’ বিএনপির এক বুদ্ধিজীবী এত দিন কথায় কথায় বিদেশিদের উদ্ধৃতি দিলেও এখন উল্টো কথা বলেছেন। তিনি বলতে শুরু করেছেন, বাইরের কেউ এসে সমাধান করতে পারবে না। বিএনপির আরেকটি পদক্ষেপে বিদেশিদের দিয়ে শেখ হাসিনাকে ক্ষমতাচ্যুত করার খোয়াব ভঙ্গ হয়েছে বলে প্রতীয়মান হয়। সংবাদে প্রকাশ, নিষ্ক্রিয় সাবেক এমপিদের সক্রিয় করার উদ্যোগ নিয়েছে বিএনপি। নানা কারণে নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়া দলের সাবেক এমপিদের সঙ্গে বৈঠক করছে হাইকমান্ড। দলীয় কর্মসূচিতে নেতাদের সক্রিয় করতেই এই উদ্যোগ। দু-এক দিনের মধ্যেই বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানেরও তাঁদের সঙ্গে বৈঠক করার কথা রয়েছে। অনেক প্রভাবশালী নেতা অতীতে আন্দোলন-সংগ্রামে নানা অবদান রাখলেও সাম্প্রতিক সময়ে তাঁদের একাংশ প্রায় নিষ্ক্রিয়। তাঁদের অনেকেই বিদেশে অবস্থান করছেন। কেউ কেউ পদ-পদবি ও দলীয় কোন্দলের কারণে নিজেদের গুটিয়ে নিয়েছেন। এদিকে বর্তমান সরকারের পদত্যাগের দাবিতে এক দফা আন্দোলনে নেমেছে বিএনপি। সরকারবিরোধী আন্দোলনে চূড়ান্ত রূপ দিতেই সাবেক এমপিদের সক্রিয় করার উদ্যোগ নিয়েছে বিএনপি। একই সঙ্গে বিগত সময়ে দল থেকে যাঁরা ধানের শীষের প্রার্থী হয়েছেন, তাঁদেরও এই উদ্যোগের আওতায় আনা হয়েছে। বিভাগীয় পর্যায়ে এসব নেতার সঙ্গে বৈঠক করবেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান। স্বভাবতই প্রশ্ন জাগে, এত দিন নিষ্ক্রিয়দের সক্রিয় করার উদ্যোগ নেওয়া হয়নি কেন? কারণ এত দিন বিদেশিদের কাঁধে চড়ে শেখ হাসিনাকে উত্খাতের স্বপ্নে বিভোর ছিল বিএনপি। কিন্তু আপাতত সে আশার গুড়ে বালি বলেই মনে হয়। বিদেশিরা ঘন ঘন বাংলাদেশে সফরে এলেও তাঁদের কাছে বিএনপির যে প্রত্যাশা ছিল তার প্রতিফলন ঘটছে না।
বিএনপি আন্দোলন করতে গিয়ে দফার পর দফা ঘোষণা করেছে। এসব দফার রফা না হলেও সময় গড়িয়েছে বছরের পর বছর। নভেম্বরে নির্বাচনের সম্ভাব্য তফসিল ঘোষণা হলে হাতে আর তিন মাস সময় আছে। গ্রামবাংলায় প্রবাদ আছে, ‘যার হয় না ৯-এ, তার হবে না ৯০-এ’। বিএনপি ১৪ বছরে যা পারেনি, আগামী তিন-চার মাসে আন্দোলন করে তা আদায় করে ফেলবে—সমীকরণটা এত সহজ নয়।