জমির নামজারির সরকারি ফি মাত্র এক হাজার ১১০ টাকা। কিন্তু পিরোজপুরের নাজিরপুরের সহকারী কমিশনার (এসিল্যান্ড) মো. মাসুদুর রহমান নেবেন চার হাজার টাকা। সম্প্রতি ফাঁস হওয়া এক অডিওতে এসিল্যান্ডকে তহশিলদারদের ঘুষ গ্রহণের নির্দেশনা দিতে শোনা যায়। এতে তিনি বলেন, ধরেন আমি চার হাজার টাকা নির্ধারণ করলাম। আপনারা কত ডিল করবেন।
এই অডিও ছড়িয়ে পড়ার পর এসিল্যান্ডের বিরুদ্ধে বিভিন্ন অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে।
সম্প্রতি উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়নের ভূমি অফিসের ইউনিয়ন ভূমি সহকারী ও উপ-সহকারী কর্মকর্তাদের (তহসিলদার) নিয়ে একটি বৈঠক হয়। ওই বৈঠকের কথপোকথনের অডিও ফাঁস হয়েছে। তাতে এসিল্যান্ড মো. মাসুদুর রহমানকে বলতে শোনা যায়, আপনারা যে পার কেসে ডিলিংস করেন তা এনসিওর করার কোন ওয়ে আছে? খোলামেলা কথা বলার জন্য এসিল্যান্ড তহসিলদারদের বলেন, আপনাদের মতামত শুনি যে আপনারা কি চাচ্ছেন? এ ব্যাপারে আমার সঙ্গে শাখারিকাঠী ইউনিয়ন তহসিলদার মো. শাখাওয়াত সাহেবের সব বিষয়ে কথা হয়েছে।
ছড়িয়ে পড়া ওই অডিওতে মাটিভাঙ্গা ইউনিয়ন তহশিলদার মো. সুজনকে বলতে শোনা যায়, দুই একরের বেশি জমি হলে তখন আমরা কত নিব? শ্রীরামকাঠী ইউনিয়ন তহশিলদার পরিমল বলেন, এটা স্যারের (এসিল্যান্ড মো. মাসুদুর রহমান) ওপর নির্ভর করে। আপনি যে ভাবে বলবেন সেভাবে আমরা নিব। তখন সদর ইউনিয়নের তহসিলদার শাহজাহান কবির বলেন, সকল কেসে যেমন ১ একর, ২ একর বা ৩ একরের চেয়েও বেশি জমির ক্ষেত্রে সমান হওয়া উচিত। যেমন পাঁচ হাজার ছিল। সেখানে আপনি বললে চার হাজার টাকা নামিয়ে আনতে পারি। আপনি যেভাবে বলবেন স্যার। তখন এসিল্যান্ড বলেন, ধরেন আমি চার হাজার নির্ধারণ করে দিলাম আপনারা কতো ডিল করবেন? প্রথমে মাটিভাঙ্গা ইউনিয়নের তহসিলদার মো. সুজন বলেন, এখানে যদি চার হাজার দেয়া যায় তা হলে মোট সাড়ে পাঁচ হাজার হলে হয়। আমরা সর্বোচ্চ ছয় হাজার টাকার বেশি নিব না।
ওই অডিওতে নাজিরপুর সদর ইউনয়িনের তহসিলদার শাহজাহান কবিরকে আরও বলতে শোনা যায়, এখানে চার হাজার, মোট ছয় হাজার টাকা হলে হয়। তখন এসিল্যান্ড বলেন, এ অর্থ বছরের জন্য প্রতিটি নামজারি কেসের জন্য আমাকে চার হাজার, আপনারা দুই হাজার মোট ছয় হাজার নিবেন বলে চূড়ান্ত করে দেন। এরপর আবার এসিল্যান্ড বলেন, একচুয়ালি (বাস্তবে) আপনারা কয় টাকা নিতে চান বলেন এবং সে দিক থেকে প্রস্তাব করেন। আমাকে চার হাজার করে দেন, আপনারা দেড় হাজার মোট সাড়ে পাঁচ হাজার করে দেন। তখন শেখমাটিয়া ইউনিয়ন তহসিলদার মো. হাসান হাওলাদার বলেন, স্যার এটা ছয় হাজার করা হোক। এসিল্যান্ড ছয় হাজার টাকা করে প্রতিটি নামজারির জন্য চূড়ান্ত করে নির্দেশনা দেন এবং বলেন ছয় হাজার টাকার ওপরে যেন না নেয়া হয়। ‘খ’ তফসিলের নামজারির কেসের জন্য এসিল্যান্ড বলেন, আমাকে ‘ক’ তফসিলের প্রতিটি কেসের জন্য ১০ হাজার টাকা করে দিবেন আর আপনারা পাঁচ হাজার টাকা করে নিবেন। মোট ১৫ হাজার টাকা নিবেন।
উপজেলা ভূমি অফিস সূত্রে জানা গেছে, কোন জমির মালিকানা পরিবর্তন হলে পুরানো মালিকের নাম বাদ দিয়ে নতুন মালিকের নামে নামজারি করতে সরকারি ভাবে এর ফি হিসাবে এক হাজার ১৭০ টাকা নেয়ার নির্দেশনা রয়েছে।
উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়নের ভুক্তভোগীরা অভিযোগ করে বলেন, সরকারি নির্দেশনা উপেক্ষা করে দীর্ঘ দিন ধরে উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়ন ভূমি অফিস তাদের চাহিদা মতো টাকা নিচ্ছেন। কিন্তু এবার এসিল্যান্ড কর্তৃক এমনভাবে সেই ঘুষের টাকার নির্ধারণ করে দেয়ায় সেবা প্রত্যাশীরা হয়রানি বেশি হবেন।
জানা গেছে, পিরোজপুর-১ আসনের সাবেক এমপি একেএমএ আউয়াল এমপি থাকা কালে নাজিরপুর উপজেলা ভূমি অফিসের পিছনে খাস জমির ওপর একটি দ্বিতল পাকা ভবন তৈরি করেন। গত ২০২০ সালের দিকে তা নিয়ে দুদকে মামলা দায়ের হলে উপজেলা ভূমি অফিস তা নিজেদের দখলে নেন। ওই ভবনসহ চারটি ইউনিয়ন ভূমি অফিসের সংস্কারের জন্য গত ৫ জুন জেলা প্রশাসকের কার্যালয় থেকে সাত লাখ ১১ হাজার ৪৬৭ টাকার টেন্ডারের মাধ্যমে ওই কাজ পাওয়া ‘মেসার্স আহনা ট্রেডিং কর্পোরেশন’ নামের এক ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। স্থানীয় সাংবাদিকদের কাছে করা এক আবেদনে জানা গেছে, এসিল্যান্ড ওই কাজ নিজে সুন্দরভাবে করার কথা বলে ঠিকাদারদের কাজ করতে দেন নি। ঠিকাদারদের মাধ্যমে কাজের টাকা উঠিয়ে তিনি নিজের একাউন্টে রাখেন। গত ২২ জুন তিনি ‘সিটি ব্যাংক’ পিরোজপুরের একটি শাখা থেকে উপজেলা ভূমি অফিসের দুই কর্মচারীর মাধ্যমে নিজ এলাকার একটি একাউন্টে ছয় লাখ ১৭ হাজার টাকা পাঠান।
সরকারি ভাবে জমির মিউটেশনের জন্য ই-নামজারি ব্যবস্থা থাকলেও সনাতনী পদ্ধতিতে মিউটেশন করা হচ্ছে। এতে স্থানীয় ভূমি অফিসের মাধ্যমে ঘুষ-দুর্নীতির সুযোগ সহ সেবা প্রাপ্তিরা হয়রানির শিকার হন।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে উপজেলা ভূমি অফিসের এক কর্মচারী জানান, তিনি প্রায়ই কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়াই অবৈধভাবে অফিসের গাড়ি নিয়ে জেলার বাইরে যান। গত বুধবার (১৩ সেপ্টেম্বর) ঢাকায় গেলে বিভাগীয় কমিশনারের নজরে আসে। এ নিয়ে তিনি ক্ষিপ্ত হন।
এ বিষয়ে এসিল্যান্ড মো. মাসুদুর রহমানের সঙ্গে মুঠোফোনে কথা হলে তিনি জানান, তিনি একটি পরীক্ষার জন্য ঢাকায় আছেন। বিষয়টি নিয়ে তাকে সাজানো ভাবে জড়ানো হয়েছে। তিনি কোন অপরাধ করেন নি বলে দাবি করেন।
অডিও কথোপকথনের বিষয়ে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ডাক্তার সঞ্জীব দাশ বলেন, অডিও’র কথোপকথন তিনি শুনেছেন। বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের জানানো হয়েছে।
উল্লেখ্য, মো. মাসুদুর রহমান গত ৮ জুন জেলার নাজিরপুরে এসিল্যান্ড হিসাবে যোগদান করেন। এর আগে তিনি সিরাজগঞ্জের জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে কর্মরত ছিলেন।