প্রেক্ষাপট
২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারি। সেনাবাহিনীর হস্তক্ষেপে ফখরুদ্দীন আহমদের নেতৃত্বে ক্ষমতায় আসলো তত্ত্বাবধায়ক সরকার। তৎকালীন বিএনপি-জামায়াত জোটের ভয়াবহ দুঃশাসন থেকে পরিত্রাণের লক্ষ্যে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে দেশব্যাপী দুর্বার আন্দোলন গড়ে উঠে। মূলত ক্ষমতায় টিকে থাকতে নানারকম ছলচাতুরীর আশ্রয় নিয়েছিলো খালেদা জিয়ার সরকার এবং বাংলাদেশের গণতন্ত্র ও রাজনীতিতে তৎকালীন অচলাবস্থা তৈরির পেছনে বিএনপি-জামায়াত জোটই দায়ী।
গ্রেফতার তারেক জিয়া
ঢাকা সেনানিবাসের ভেতরে মইনুল রোডের বাড়িতে তারেক রহমান তখন অস্থির সময় পার করছেন। তার বিরুদ্ধে ২০০১-২০০৫ সাল পর্যন্ত বিভিন্ন দুর্নীতির নানা রিপোর্ট প্রকাশিত হচ্ছে। সদ্য সাবেক প্রধানমন্ত্রী পুত্র হিসেবে ক্ষমতার অপব্যবহার,হাওয়া ভবন তৈরি করে সরকারের সমান্তরালে ছায়া সরকার পরিচালনা ,জঙ্গিবাদে মদদ ,সরকারি সকল কাজের শতকরা ১০ ভাগ চাঁদা নেয়াসহ তার সকল কুকীর্তির খবর সামনে চলে আসতে থাকে। যেকোনো সময় আটক হতে পারেন তারেক রহমান এমন সংবাদ গণমাধ্যমে আসতে থাকে। অবশেষে সব জল্পনা-কল্পনার অবসান ঘটিয়ে দুর্নীতির অভিযোগে ২০০৭ সালের ৭ মার্চ তারেক রহমানকে গ্রেপ্তার করা হয়।
তারেকের মুচলেকা ও লন্ডনে পলায়ন
২০০৮ সালের গোড়ার দিকেই অনেকটা পরিষ্কার হয়ে যায় যে, সেনা-সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে সে বছরের শেষ নাগাদ সাধারণ নির্বাচনের আয়োজন করতে হবে। সব দলের অংশগ্রহণে একটি অবাধ নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যাপারে সরকার ও সেনাবাহিনী প্রধানের ওপর আন্তর্জাতিক চাপও বাড়তে থাকে। তখন থেকেই রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে আলাপ-আলোচনার প্রয়োজন অনুভব করে তত্ত্বাবধায়ক সরকার। আওয়ামী লীগ এবং অন্যান্য দল নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে চাইলেও বিএনপি নির্বাচনে অংশগ্রহন করতে চায় নি। খালেদা জিয়ার সাফ কথা, তারেক রহমানের মুক্তি ছাড়া কোন ভাবেই বিএনপি নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবে না।
সবশেষে বিএনপির সাথে তৎকালীন সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের একটি সমঝোতা হয়। তারেক রহমানকে মুক্তি দেয়া হবে কিন্তু তিনি আর রাজনীতিতে অংশগ্রহণ করতে পারবেনা। তারেক জিয়া লজ্জাজনক এক মুচলেকায় স্বাক্ষর দিয়ে ৩ রা সেপ্টেম্বর জেল থেকে ছাড়া পায় এবং চিকিৎসার নাম করে ১১ সেপ্টেম্বর লন্ডনে পালিয়ে যায়। এবং বিএনপি এই শর্ত মেনে নিয়ে ২০০৮ সালের নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে।
অথচ ৩ সেপ্টেম্বর বিএনপি তারেক জিয়ার কারামুক্তি দিবস পালন করে! এটা কিসের কারামুক্তি দিবস? এটা তো মুচলেকা দিবস। যে মুচলেকা দিয়ে ১১ সেপ্টেম্বর দেশ থেকে পালিয়ে যায় তারেক জিয়া। রাজনীতিতে এই পলায়ন চরম লজ্জার, অপমানের!
তারেকের পলায়ন নিয়ে কী লিখেছেন বিএনপি নেতা ব্যারিস্টার মওদুদ
খালেদা জিয়ার সাথে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কী ধরণের সমঝোতা হয়েছিল, সে প্রসঙ্গে বিএনপি নেতা মওদুদ আহমেদ তার ‘বাংলাদেশ: ইমার্জেন্সি অ্যান্ড দ্যা আফটারম্যাথ (২০০৭-২০০৮)’ শিরোনামের বইতে বলেছেন “ছেলেদের মুক্তি এবং বিদেশ পাঠানোর বিনিময়ে খালেদা জিয়া হয়তো নির্বাচনে অংশগ্রহণের শর্ত মেনে নিয়েছিলেন।“
বিএনপি নেতা মওদুদ আহমদ তার আরেকটি বই ‘কারাগারে কেমন ছিলাম (২০০৭-২০০৮)’এ লিখেছেন,
‘এমনও হতে পারে তিনি (খালেদা জিয়া) জেনারেলদের সাথে এই সমঝোতা করেছিলেন যে, তারেক রহমান আপাতত নিজেকে রাজনীতিতে জড়াবেন না এবং এ মর্মে তারেক রহমান কোনো সম্মতিপত্রে স্বাক্ষরও দিয়ে থাকতে পারেন।’
আপোষহীন নাকি আপোষকামী নেত্রী খালেদা জিয়া?
২০০৮ সালে তৎকালীন সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাথে এক আপোষে গিয়েছিলেন খালেদা জিয়া। তারেকের মুক্তির বিনিময়ে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেছিলেন। এই আপোষ বা সমঝোতা বিএনপির নেতারাই প্রকাশ্যে বলেছেন। প্রয়াত বিএনপি নেতা ব্যারিস্টার মওদুদ আহমেদ তো নিজের বইয়ে তা উল্লেখ করে গিয়েছেন। অবশ্য এই আপোষ খালেদা জিয়ার জন্য নতুন কিছু না। ১৯৮৬ সালের নির্বাচনেও স্বৈরাচার এরশাদের সাথে আপোষ করেছিলেন বেগম জিয়া।
আওয়ামী লীগ বরাবরই গনতন্ত্রপন্থী ও নির্বাচনমুখী একটি দল, শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ চেয়েছিল নির্বাচনের ম্যান্ডেটের মাধ্যমে স্বৈরাশাসককে জবাব দিতে। কিন্তু খালেদা জিয়া ভিন্ন পথে হেঁটেছিলেন। অনেক রাজনীতি বিশ্লেষকের দাবি, জিয়াউর রহমান হত্যায় তথাকথিত ১৩ জনকে ফাঁসিতে ঝুলানোর কৃতজ্ঞতা থেকে বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়া সেই নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেনি।
যে আপোষের মাধ্যমে এরশাদকে এককভাবে ক্ষমতা ব্যবহারের বৈধতা দিলো খালেদা জিয়া সেই কারণকে সমানে এনেই কিনা বিএনপি খালেদা জিয়াকে বলে “আপোষহীন নেত্রী”! অথচ এই তথাকথিত আপোষহীন নেত্রী সেদিন স্বৈরশাসককে যে ক্লিনশিট দিয়েছিল, যেভাবে গণতন্ত্রকামী এরশাদবিরোধী অন্দোলনের সাথে সম্পৃক্ত দলগুলোকে ছেড়ে গিয়েছিল, সেটাই বাংলাদেশের রাজনীতির গতিপথ পরিবর্তনের সবচেয়ে বড় নিয়ামক হিসাবে কাজ করেছে। সেটাই ছিল ৭২’এর সংবিধানের উপর দ্বিতীয় পেরেক, যার প্রথমটি গেঁথেছিলেন সামরিক শাসক জিয়াউর রহমান। সেই পরিবর্তনের ক্রমধারায় বাংলাদেশে ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল, সংগঠন, মৌলবাদ, জঙ্গিবাদ, মাদ্রাসাশিক্ষার নামে পাকিস্থানি, তালেবানি, আরবী সংস্কৃতি আমদানী করে আর বাংলাদেশ পিছিয়ে যেতে থাকে।
ব্রিটেনে রাজনৈতিক আশ্রয়
লন্ডনে যাওয়ার পর থেকে বিএনপির তরফ থেকে বরাবরই বলা হচ্ছিল যে, তারেক জিয়া সেখানে চিকিৎসার জন্য অবস্থান করছেন। তবে ২০১৮ সালের ২৪ এপ্রিল বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর প্রথমবারের মতো স্বীকার করেন যে, তারেক রহমান ব্রিটেনে রাজনৈতিক আশ্রয়ের আবেদন করেছিলেন এবং এক বছরের মধ্যেই সেটি গৃহীত হয়েছে।