প্রেক্ষাপট
ইমান্যুয়েল ম্যাক্রন, ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের সবচেয়ে প্রভাবশালী দেশ ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট। গত তিন দশকের মধ্যে এই প্রথমবার বাংলাদেশ সফরে আসছেন ফ্রান্সের কোন প্রেসিডেন্ট। ভারতে অনুষ্ঠিতব্য দুইদিনের জি-২০ সম্মেলনে অংশগ্রহণ শেষে ১০ সেপ্টেম্বর তিনি বাংলাদেশে আসবেন। ফরাসি প্রেসিডেন্টের সফরসঙ্গী হিসেবে বাংলাদেশে আসছেন ফ্রান্সের ইউরোপ ও ফরেন এফেয়ার্স মিনিস্টার ক্যাথেরিন কলোনা।
ফরাসি প্রেসিডেন্ট দপ্তরের বিবৃতি
ফ্রান্সের প্রেসিডেন্টের দপ্তর থেকে বাংলাদেশ সফরের বিষয়ে বিবৃতিতে উল্লেখ করা হয়েছে, “বাংলাদেশকে এমন একটি দেশ, যেটি দ্রুত অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি এবং তার অংশীদারিত্বে বৈচিত্র্য আনতে চাইছে।“ বিবৃতিতে বলা হয়েছে, “বাংলাদেশ ও ফ্রান্স দু’দেশই বিশ্বব্যাপী চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় দারুণ একতা দেখায়। বিশেষ করে, প্যারিস এজেন্ডা ফর পিপলস অ্যান্ড দ্য প্ল্যানেট-এর পরিকাঠামোর মধ্যে এই ঐক্য প্রতিফলিত হয়। এই পরিকাঠামো-কে বাংলাদেশ সক্রিয়ভাবে সমর্থন করে।”
ফ্রান্স বাংলাদেশ সম্পর্ক
বাংলাদেশের রপ্তানিমুখী গার্মেন্টস এর একটা বড় অংশ যায় ফ্রান্সে। ফ্রান্স আমাদের পোশাক রপ্তানির অন্যতম ভালো বাজার, যেখানে বার্ষিক রপ্তানি প্রায় আড়াই বিলিয়ন ডলারের
২০২১-২২ এর তথ্য অনুযায়ী বাংলাদেশে প্রায় ১.৩৮০ বিলিয়ন ডলারের রপ্তানি করেছে ফ্রান্সে, বিপরীতে ফ্রান্স থেকে আমদানী করেছে প্রায় ১০৯ মিলিয়ন ডলারের পণ্য।
ফ্রান্সের কাছ থেকে নৌযান ও হেলিকপ্টারসহ সামরিক সরঞ্জাম কিনেছে বাংলাদেশ।
বাংলাদেশ এবং ফ্রান্স উভয়ই জলবায়ু পরিবর্তন সমস্যা মোকাবিলায় সক্রিয়ভাবে জড়িত। ফ্রান্স নবায়নযোগ্য শক্তি এবং জলবায়ু অভিযোজন–সম্পর্কিত প্রকল্পসহ জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় বাংলাদেশের কিছু প্রচেষ্টাকে সমর্থন করেছে।
বাংলাদেশ জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে সেনাদের অবদান রেখেছে এবং ফ্রান্স বিশ্ব শান্তিরক্ষা প্রচেষ্টায় বাংলাদেশের ভূমিকাকে স্বীকৃতি ও প্রশংসা করেছে।
কেনো এই সফর বাংলাদেশের কাছে গুরুত্বপূর্ণ
ফ্রান্স বিশ্ব রাজনীতি ও অর্থনীতিতে প্রধানতম খেলোয়াড়দের একটি, জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্য যারা ইউরোপীয় ইউনিয়নে কেন্দ্রীয় ভূমিকা পালন করে। আন্তর্জাতিক কূটনীতি ও অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতায় ফ্রান্স উল্লেখযোগ্য অবদান রাখে।
বাংলাদেশের জাতীয় নির্বাচনের আগ মুহুর্তের এই সফর কূটনীতিতে বাংলাদেশ সরকারকে এক ধাপ এগিয়ে নিয়ে গিয়েছে। কারণ ফ্রান্সের কূটনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক প্রভাব বৈশ্বিক বিষয়াবলির গতিপথকে প্রভাবিত করে। তাই আগামী নির্বাচনে ইউরোপ ও পশ্চিমা বিশ্ব থেকে সরকারের প্রতি নানামুখী যে চাপ রয়েছে তা প্রশমিত করার ভালো একটি উপলক্ষ্য হতে পারে এই সফর।
ফ্রান্স বিশ্বের শীর্ষ দুটি জোট জি-৭ এবং জি-২০–এর সদস্য, যেখানে দেশটি বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক নীতি তৈরি ও পরিবর্তনে অবদান রাখে। এক্ষেত্রে বাংলাদেশ নিজের অবস্থান পরিস্কার করতে পারবে এবং অর্থনৈতিক অগ্রগতির ক্ষেত্রে নিজেকে আরো উচ্চতায় নিয়ে যেতে সক্ষম হবে।
ম্যাক্রন এর বাংলাদেশ সফরে স্বাগত জানাতে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর বিমান বন্দরে যাবার কথা রয়েছে। এর অর্থ দাঁড়ায়, বাংলাদেশ এই সফরকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিচ্ছে। আরো বেশ কিছু দ্বিপাক্ষিক চুক্তি হবার কথা রয়েছে বাংলাদেশ ফ্রান্সের মধ্যে।
ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোর আসন্ন বাংলাদেশ সফরকালে মহাকাশে আরও একটি নতুন স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণের চুক্তি সই হচ্ছে। ফ্রান্সের সহায়তায় এবার যে স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণ করা হবে তার নাম বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-২। এটি একটি ‘আর্থ অবজারভেটরি’ ভূ-উপগ্রহ কেন্দ্র। এর মাধ্যমে পৃথিবী তথা বাংলাদেশের স্থলভাগ ও জলভাগ পর্যবেক্ষণ করা হবে।
বাংলাদেশের সমুদ্রসীমা চিহ্নিত হওয়ায় আমাদের সমুদ্র অঞ্চল বৃদ্ধি পেয়েছে। ফলে সমুদ্র অঞ্চলে নজরদারি বাড়ানো সম্ভব হবে। বাংলাদেশের সমুদ্রসীমায় কেউ অনধিকার প্রবেশ কিংবা কোনো অপতৎপরতা চালাচ্ছে কি না সেটাও এই স্যাটেলাইটের মাধ্যমে জানা যাবে।
ফ্রান্সের কাছে এই সফরের গুরুত্ব কতোটুকু?
সাম্প্রতিক সময়ে আফ্রিকার দেশগুলোতে ফ্রান্সের উপনিবেশবাদী আধিপত্যের এক পতন পর্বের শুরু হয়েছে বলে আন্তর্জাতিক মহল ধারণা করছে। এই পরিস্থিতিতে সম্ভাব্য অর্থনৈতিক সংকটের ঝুঁকিতে রয়েছে ফ্রান্স। তাই ফ্রান্সের দরকার নতুন ব্যবসায়িক গন্তব্য। ফলে অনেকের ধারণা যে, জি-২০ সম্মেলনে যোগ দেওয়ার মূল উদ্দেশ্য হলো, এ অঞ্চলে বাণিজ্যের বিস্তার ঘটানো।
ইউরোপ ও আফ্রিকায় শক্তিশালী অবস্থান থাকলেও দক্ষিণ এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে ফ্রান্সের কোন প্রভাব নেই বললেই চলে। তাই দেশটিকে ইদানীং কিছু বিষয়ে চীন-রাশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রের মাঝামাঝি একটা অবস্থান নেওয়ার চেষ্টা করতে দেখা যায়।
ইন্দো প্যাসিফিক অঞ্চলে পশ্চিমাদের প্রভাব বৃদ্ধির জন্য আরো অনেক দেশের মতো ফ্রান্সও বাংলাদেশকে বাণিজ্যিক বন্ধু হিসাবে বিবেচনা করছে। প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম থেকে শুরু করে সামরিক অস্ত্রের জন্য ফ্রান্স বাংলাদেশকে ক্রেতা হিসাবে চাইবে বলে ধারণা করছেন বিশ্লেষকরা। এছাড়াও জলবায়ুগত পরিবর্তন মোকাবেলায় ফ্রান্স বাংলাদেশের সাহায্য সহযোগিতা সম্পর্কিত চুক্তি করবার কথা রয়েছে।
চুক্তি যাই হোক, সর্বোচ্চ পর্যায়ের বাংলাদেশ ও ফ্রান্সের এই সফর দীর্ঘমেয়াদি সম্ভাবনার নতুন নতুন ক্ষেত্র উন্মোচন করবে বলেই ধারণা করা যায়। যার শুরুটা হবে ১০ই সেপ্টেম্বর ফরাসি প্রেসিডেন্টের বাংলাদেশের সফরের মধ্যে দিয়ে।