প্রেক্ষাপট
১৯৭৫ সালের ১১ নভেম্বর বেতার ও টেলিভিশন ভাষণে মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান বলেছিলেন, “আমি রাজনীতিবিদ নই। আমি একজন সৈনিক। রাজনীতির সাথে আমার কোন সম্পর্ক নেই এবং আমাদের সরকার সম্পূর্ণ নির্দলীয় ও অরাজনৈতিক।”
একজন সৈনিক বা একজন অরাজনৈতিক ব্যক্তি কিভাবে নানা অপ-কৌশল অবলম্বন করে ধাপে ধাপে ক্ষমতার শীর্ষে চলে যেতে পারেন, সেটিই করে দেখিয়েছিলেন মেজর জিয়াউর রহমান। পাকিস্তানের সেনাপতি আইয়ুব খান যেভাবে নিজেকে ধাপে ধাপে ক্ষমতার শীর্ষে নিয়ে গিয়েছিলেন, জেনারেল জিয়াও তার পদাঙ্ক অনুসরণ করেই এগুতে থাকেন এবং অবশেষে গন্তব্যে পৌঁছে যান।
১ম ধাপ– বঙ্গবন্ধুকে হত্যাকাণ্ড এবং সেনাপ্রধানের পদ দখল
- ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার মাধ্যমে জিয়া তার প্রথম ধাপটি সম্পন্ন করে। এ হত্যাকাণ্ডের আরেক কুশীলব খন্দকার মোশতাক ১৬ আগস্ট প্রেসিডেন্টের ক্ষমতা দখল করে এবং ২৪ আগস্ট জিয়াউর রহমান সেনাবাহিনীর প্রধান হিসেবে ক্ষমতার দৃশ্যপটে চলে আসে।
- সেনাপ্রধান হয়ে সবার আগে জিয়া সেনাবাহিনীতে শৃঙ্খলা ফেরানোর নামে তাকে চ্যালেঞ্জ জানানো সেনা অফিসারদের হত্যা করতে লাগল, হত্যা করল মুক্তিযোদ্ধা সৈনিকদের, আওয়ামী লীগের জাতীয় চারনেতাও বাদ যায়নি তার রোষানল থেকে। জেলখানায় বন্দী অবস্থায় তাদের নির্মমভাবে হত্যার নির্দেশ দেয় জিয়াউর রহমান।
- এমনকি যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্য করা দালাল আইন বাতিল এবং বঙ্গবন্ধুর খুনিদের রক্ষাকবচ হিসেবে মোশতাকের জারিকৃত ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ জিয়াউর রহমানের সংসদেই পাশ হয় ।
২য় ধাপ–প্রধান সামরিক আইন প্রশাসকের পদ দখল
- ৩রা নভেম্বরের সেনা অভ্যুত্থানে খন্দকার মোশতাকের পতন ঘটে। জিয়া পদচ্যুত ও গৃহবন্দী হয়। জিয়ার সমর্থকরা ৭ই নভেম্বর পাল্টা সেনা অভ্যুত্থান ঘটিয়ে মুক্তিযোদ্ধা সেনা-কর্মকর্তা ও সৈনিকদের হত্যা করে জিয়াউর রহমানকে মুক্ত করে। এরপরই জিয়া ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে চলে আসে। সেনাপ্রধানের পদে ফিরলেও রাষ্ট্রপতির পদে মোশতাককে আর সমর্থন করেনি জিয়া।
- ১৯৭৫ সালের ৬ নভেম্বর দেশের রাষ্ট্রপতির দায়িত্বভার পান প্রধান বিচারপতি আবু সাদাত মোহাম্মদ সায়েম। তিনি একই সাথে দেশের রাষ্ট্রপতি এবং প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক। রাষ্ট্রপতি ও প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক উভয়ক্ষেত্রেই বিচারপতি সায়েম ছিলেন ক্ষমতাহীন। মূল ক্ষমতা ছিল জিয়ার হাতে। ১৯ নভেম্বর জিয়া তার ক্ষমতা ব্যবহার করে রাষ্ট্রপতি আবু সাদাম মোহাম্মদ সায়েমের কাছ থেকে প্রধান সামরিক আইন প্রশাসকের পদটি কেড়ে নেয়।
৩য় ধাপ–রাষ্ট্রপতির পদ দখল
- খন্দকার মোশতাক রাষ্ট্রপতি থাকাকালীন একবার ঘোষণা করেছিলেন, ১৯৭৭ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। বিচারপতি সায়েম রাষ্ট্রপতির পদে আসীন হয়েও একই কথা বলেছিলেন, “সম্ভব হলে ’৭৭ এর ফেব্রুয়ারির আগেই নির্বাচন।”
- কিন্তু জিয়াউর রহমান নির্বাচন দিতে চাননি। নির্বাচন হলে জিয়া তার অভীষ্ট লক্ষ্যে কোনোভাবেই পৌঁছাতে পারবে না। তাই ১৯৭৭ সালের ২১ এপ্রিল রাষ্ট্রপতি সায়েমকে বন্দুকের নলের ভয় দেখিয়ে নিজেই রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা দখল করে বসে।
- এ বিষয়ে ক্ষমতাচ্যুত রাষ্ট্রপতি আবু সায়েম তার বই বঙ্গভবনের শেষ দিনগুলিতে লিখেছেন-
“জিয়া বঙ্গভবনে আসতেন মধ্যরাতে অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে। তার সাঙ্গপাঙ্গরা অস্ত্র উঁচিয়ে রাখত। আমি প্রায়ই মনে করতাম এটাই বোধ হয় আমার শেষ রাত। সংবিধানের ৪টি মূল স্তম্ভ বাতিল সংক্রান্ত একটি সামরিক ফরমান আমার কাছে স্বাক্ষরের জন্য আসে, আমি স্বাক্ষর না করে রেখে দেই। পরদিন রাত ১১ টায় বুটের শব্দে আমার ঘুম ভাঙে। সেনাপ্রধান জিয়া অস্ত্রসস্ত্র নিয়ে বঙ্গভবনে আমার শয়নকক্ষে প্রবেশ করে। জিয়াউর রহমান আমার বিছানায় তার বুটসহ পা তুলে দিয়ে বলেন সাইন ইট। তার এক হাতে ছিল স্টিক, অন্য হাতে রিভলবার। আমি কাগজটা পড়লাম, আমার পদত্যাগপত্র। যাতে লেখা অসুস্থতার জন্য আমি রাষ্ট্রপতির পদ থেকে পদত্যাগ করলাম। আমি জিয়াউর রহমানের দিকে তাকালাম, ততক্ষণে আট দশ অস্ত্রধারী আমার বিছানার পাশে অস্ত্র উঁচিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। জিয়া আবার আমার বিছানায় পা তুলে আমার বুকের সামনে অস্ত্র উঁচিয়ে বললেন, সাইন ইট।আমি কোনমতে সই করে বাঁচলাম।”
এভাবেই প্রাণ নাশের হুমকি দিয়ে বন্দুকের নলের ডগায় জিয়া আবু সায়েমকে ক্ষমতাচ্যুত করে নিজেই রাষ্ট্রপতি বনে গেলেন।
রাষ্ট্রপতি হয়ে ক্ষমতা পাকাপোক্ত করতে জিয়ার কর্মকাণ্ড
- রাষ্ট্রপতির পদ দখল করে নিজের ক্ষমতাকে কুক্ষিগত করতে জিয়ার প্রধান লক্ষ্য ছিল মানুষের অধিকার রহিত করে স্বৈরতন্ত্রের বীজ বপন করা।
- জিয়া প্রথমেই ধর্মীয় বিভাজন সৃষ্টি করে জাতিকে দ্বিধাবিভক্ত করার কূটকৌশল গ্রহণ করে। নিজের ফায়দা হাসিলের জন্য দেশের অভ্যন্তরে ভারতবিরোধী সেন্টিমেন্ট তৈরি করে, সাম্প্রদায়িকতাকে উসকে দেয়।
- তার এসকল কাজে সমর্থন জোগায় জামায়াতে ইসলামী, মুসলিম লীগ, নেজামে ইসলাম, পিডিপির মত দলগুলো। সম্পূর্ণ পাকিস্তান ভাবধারায় দেশ পরিচালনা করতে থাকে জিয়া।
হ্যাঁ / না ভোট আয়োজন ১৯৭৭
- জিয়াউর রহমান তখন একইসাথে দেশের রাষ্ট্রপতি, সেনাপ্রধান এবং প্রধান সামরিক আইন শাসক। সেনাবাহিনীতে দৃশ্যত তাঁকে চ্যালেঞ্জ করার মতো কেউ ছিল না। দেশের ভেতরে রাজনৈতিক বিরোধীরা বিভক্ত, বিচ্ছিন্ন এবং দিশেহারা। তারপরেও জিয়াউর রহমানকে প্রমাণ করতে হবে, তার পেছনে জনসমর্থন আছে; শুধু বন্দুকের জোরে ক্ষমতায় বসেনি।
- সামরিক শাসনকে পর্যায়ক্রমে বৈধ করার জন্য জিয়া নানামুখী তৎপরতা শুরু করে। ১৯৭৭ সালের ৩০ মে তার রাষ্ট্রপতি নিয়োগকে বৈধতা দেয়ার জন্য প্রথমেই আয়োজন করে হ্যাঁ/না ভোটের। মূলত এই হ্যাঁ/না ভোটের মাধ্যমেই বাংলাদেশের নির্বাচনব্যবস্থা প্রশ্নবিদ্ধ হওয়া শুরু করে।
- এতে ভোটার উপস্থিতি ২ শতাংশের নিচে হলেও দেখানো হয় ৮৮ শতাংশ। আর প্রদত্ত ভোটের ৯৮ শতাংশই দেখানো হয় জিয়ার পক্ষে। ভোটার উপস্থিতির এ হার মোটেও বিশ্বাসযোগ্য ছিল না।
- হ্যাঁ/ না ভোটের মাধ্যমে শুধু রাজনৈতিক বৈধতার একটি ছাড়পত্র তৈরি করেছিল জিয়াউর রহমান।
প্রহসনের রাষ্ট্রপতি নির্বাচন ১৯৭৮
- বাংলাদেশের আর্মি এক্টের ২৯২,২৯৩ বিধিতে সামরিক বাহিনীর কোন সদস্য তার চাকরির মেয়াদ শেষ না হলে নির্বাচনে প্রার্থী হতে পারবে না। আইনে সুস্পষ্টভাবে এ কথা উল্লেখ থাকলেও সেনাবাহিনী প্রধান থাকাকালীন জিয়াউর রহমান ১৯৭৮ সালে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেন।
- এছাড়া রাষ্ট্রপতি নির্বাচন অধ্যাদেশ অনুযায়ী কোনো সরকারি চাকরিজীবী ও সরকারি বেতন গ্রহীতার রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে প্রার্থী হবার সুযোগ ছিল না।
- কিন্তু জিয়া সকল আইন ভঙ্গ করে ১৯৭৮ সালের ৩ জুন নির্বাচনে অংশগ্রহণ নেয়। আর্মি, পুলিশ এবং সরকারি চাকরিজীবীদের ন্যাক্কারজনকভাবে তার পক্ষ অবলম্বন করতে বাধ্য করা হয়।
- প্রহসনের এই নির্বাচনে প্রকাশ্য ও গোপন কারচুপির মাধ্যমে শতকরা ৭৬ ভাগ ভোট নিজের দেখিয়ে জিয়া রাষ্ট্রপতি বনে যান। ১৫ ডিসেম্বর এক ফরমান জারির মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় শাসনব্যবস্থায় পরিবর্তন এনে সব ক্ষমতা রাষ্ট্রপতির নামে করে নিজের হাতে ক্ষমতা কুক্ষিগত করে নেয়।
জাগদল গঠন
- দিন দিন রাজনৈতিক দলগুলোর তৎপরতা বৃদ্ধি এবং নির্বাচনমুখী রাজনীতি শুরু হলে জিয়াউর রহমান একটি রাজনৈতিক ফ্রন্ট গঠনের পরিকল্পনা করতে থাকে। তার উদ্দেশ্য ছিল, বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সমন্বয়ে একটি বিস্তৃত প্লাটফর্ম বানানো। একটা নির্দিষ্ট দর্শন ও কর্মসূচীর চেয়ে তার কাছে বেশি গুরুত্বপূর্ণ ছিল ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগের পাল্টা একটা বড়সড় মঞ্চ তৈরি করা।
- জিয়াউর রহমান ইতোমধ্যে রাজনীতিবিদদের যোগাযোগ শুরু করে দিয়েছিলেন। প্রথম দিকে তিনি যাদের সাথে কথাবার্তা বলা শুরু করেন, তাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন ভাসানী-ন্যাপের সভাপতি বঙ্গবন্ধু সরকারের সময় দালাল আইনে আটক মশিউর রহমান যাদু মিয়া।
- তখনকার সেনাবাহিনীর প্রিন্সিপাল স্টাফ অফিসার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল নুরুল ইসলাম শিশুর অফিসে রাতের বেলায় রাজনৈতিক দলের শীর্ষ নেতারা আসতেন এবং কথাবার্তা বলতেন। এই নুরুল ইসলাম শিশু ছিল আইএসআইয়ের এজেন্ট।
- জিয়া কখনো-সখনো সেখানে উপস্থিত থাকতেন। জিয়ার একান্ত সচিব কর্ণেল অলি আহমদের সাথে মাঠ পর্যায়ের অনেক লোকের যোগাযোগ ছিল।
- সে লক্ষ্যে ১৯৭৮ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি ‘জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক দল’ বা ‘জাগদল’ নামে নতুন একটি রাজনৈতিক দল তৈরির ঘোষণা দেন। তিনি নিজে থাকলেন নেপথ্যে। জাগদলের আহবায়ক করা হল জিয়ার একান্ত অনুগত ভাইস প্রসিডেন্ট আব্দুস সাত্তারকে।
জাগদল থেকে বিএনপি
- সে সময় জাগদল রাজনীতিতে তেমন ঢেউ তুলতে পারেনি। রাজনৈতিক মাঠের চেনা মুখগুলো জাগদলে খুব কমই যোগ দিয়েছিল। এছাড়া চতুর জিয়া অল্প সময়ের মধ্যেই বুঝতে পেরেছিল, জোটের মধ্যে শতভাগ অনুগত একটা দল না থাকলে জোটকে নিয়ন্ত্রণ করা যাবে না।
- তাদের একতার একটাই ভিত্তি ছিল, তারা সবাই ছিল আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে একাট্টা। নানান মত ও পথের জাগদল নিয়ে জিয়াউর রহমান স্বস্তিতে ছিল না।
- জিয়া ‘একমনা’ লোকদের নিয়ে আলাদা দল তৈরির সিদ্ধান্ত নিলেন এবং ১৯৭৮ সালের ২৮ আগষ্ট ‘জাগদল’ বিলুপ্তির ঘোষণা করা হয়।
- ১লা সেপ্টেম্বর ঢাকার রমনা রেস্তোরা প্রাঙ্গনে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে জিয়াউর রহমান নতুন রাজনৈতিক দলের ঘোষণা দেন, যার নাম বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল, সংক্ষেপে বিএনপি।
- একই সাথে দলের চেয়ারম্যান হিসেবে নিজের নাম ঘোষণা করেন।
ন্যাপের মার্কা ধানের শীষ যেভাবে হলো বিএনপির
- মাওলানা ভাসানী হাসপাতালে মৃত্যুশয্যায় শায়িত। অসুস্থ ভাসানীকে দেখতে হাসপাতালে গেলেন সেনাপ্রধান জিয়াউর রহমান। ভাসানীর কানে কানে কী একটা বললেন জিয়া, শুনে মুখটা ফ্যাকাশে হয়ে গেল ভাসানীর। এর কিছুদিন পর মারা গেলেন মাওলানা ভাসানী।
- জিয়া ভাসানীকে কানে কানে কী বলেছিলেন, তা না জানা গেলেও, কথাটি যে ভাসানীর মনঃপুত হয়নি সেটা ভাসানীর ফ্যাকাশে মুখ দেখেই আন্দাজ করেছিল সেখানে অবস্থানকারী অনেকেই। তারাই পরবর্তীতে বই লিখে এ ঘটনা জানিয়েছেন।
- অবশ্য এর প্রমাণ পাওয়া যায়, ভাসানী মারা যাওয়ার দুই বছর পর ১৯৭৮ সালে বিএনপি গঠনের পর।
১৯৭৩ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভাসানীর নেতৃত্বে ন্যাপ ধানের শীষ প্রতীকে অংশগ্রহণ করেছিল। ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্ট থেকে বেরিয়ে যাবার পরই ন্যাপ ধানের শীষ মার্কা নিয়েছিল। আর ন্যাপের সেই ধানের শীষ প্রতীককেই জিয়া বিএনপির প্রতীক বানিয়ে ১৯৭৮ সালে দল গঠন করে। পুরো ন্যাপ বিলীন হয়ে যায় বিএনপিতে, ন্যাপের মার্কাও নিয়ে নেয় বিএনপি।